আবু সঈদ আহমেদ
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার এক বড় অংশ তফশীলি জাতি, উপজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে কোন দল কেবলমাত্র এই সমাজের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী সাফল্য পাবে, যেমনটা উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি বা বহুজন সমাজ পার্টি কিম্বা বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল পেয়ে এসেছে, সেটা বলা চলে না। তার কারণও আছে অনেক। প্রথমেই যেটা নজরে আসে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জাতপাতের সমস্যা স্থূলভাবে নেই। একেবারেই নেই তা নয়। শাঁস ছাড়ালে আঁটির মত এক এক করে বেরিয়ে আসে সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো, কোটার মাল প্রভৃতি মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে। এছাড়াও অনেক চোরাগোপ্তা ঘৃণার প্রকাশ তো আছেই। নির্বাচনী রাজনীতির কথা যদি বলতেই হয় এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর পদে কোন তফশীলি জাতি, উপজাতি কিম্বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষকে দায়িত্ব নিতে দেখা যায় নি। অর্থমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীপদে এই সমাজ থেকে কেউ আসবেন সেটাও অত্যন্ত কষ্টকল্পনা।
এবার যদি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জাতপাতের সমস্যা স্থূলভাবে না থাকার কারণ দেখতে হয়, তাহলে একটা বড় কারণ হল অন্যরাজ্যের মত রাজপুত বা জাঠের মত ক্ষত্রিয় জনসংখ্যার অভাব। যখন এই বাংলায় জমিদারদের লেঠেলবাহিনী রাখার সুযোগ ছিল তখন জাতপাত পুরোদমেই ছিল। রাজপুত প্রভাব অবশ্যই এই রাজ্যে আছে, কাশ্মীরের রাজনীতিতে ডোগরা রাজপুতদের মত পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে মারোয়াড়ী প্রভাবিত, সেটা জাতপাতের স্থূল প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট নয়।
জাতপাতের রাজনীতি প্রকটভাবে না থাকার আরেকটি কারণ খতিয়ে দেখা যাক। সেটি হেঁয়ালির মত শোনালেও সত্যি, অবিভক্ত বাংলায় দলিত রাজনীতির সাফল্য এবং এই সাফল্যে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির প্রতিক্রিয়া। এই নিয়ে কথা বলার জন্য বেশ কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। উনবিংশ শতকের পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ অঞ্চল। শেখ মুজিবেরও বহু আগে এই এলাকার ওড়াকান্দী গ্রামে এক যুগান্তকারী মহামনীষী জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষার গুরুত্ব। তাই সন্তানকে শিক্ষা দিতে গেলেন কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী পাঠশালায় তাঁর ছেলের ঠাঁই হল না। শেষে মুকুম মিয়াঁর মক্তবে শুরু হল তাঁর পুত্রের শিক্ষা। এবার তিনি বুঝলেন সঙ্ঘবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব গড়ে তুললেন এমন আন্দোলন যার পরিণামে একটি অস্পৃশ্য জাতি হয়ে উঠল এক অনিবার্য্য শক্তি। হরিচাঁদ ঠাকুর মুকুম মিয়ার পাঠশালায় পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দলিত মুসলিম ঐক্যের যে নয়া নজির গড়ে তুলেছিলেন তা চলেছিল বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আজ মতুয়া আন্দোলন বলতে মূলত নমশূদ্রদেরকেই বোঝায়। কিন্তু হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের আন্দোলন ছিল সকলের জন্য,
“নমশুদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার।
কাপালি মাহিষ্য দাস চামার কামার।।
পোদ আসে তাঁতী আসে আসে মালাকার।
কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার।।”
মীড সাহেবের সাথে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ পরিবারের হৃদ্যতা তো কিংবদন্তীসম।
এরপরেও শিক্ষাক্ষেত্রে মতুয়া আন্দোলন আবার ধাক্কা খায় যখন বর্ণহিন্দু গিরীশ বসু নমশুদ্রদের জন্য তাঁর পিতার নামে বিদ্যালয় করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েও অস্বীকার করেন। বর্ণহিন্দুদের শিক্ষাক্ষেত্রে মৌরসীপাট্টা ভাঙতে পারে তরফ থেকে এরকম কিছুর বহু বিরোধ এসেছে সংগঠিত ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে মাধ্যমিক বোর্ড প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে। সাম্প্রতিক মিল্লি আলামীন গার্লস বা মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গড়িমসীও এরই আরেক নিদর্শন।
এই প্রেক্ষাপটেই সেন্সাস রিপোর্টে বাংলার নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর বিরূপ বর্ণণার প্রতিবাদে ডঃ মীড তাঁর নমশূদ্রসঙ্গীদের নিয়ে ছোটলাট হেয়ার সাহেবকে পরিস্থিতির বিবরণ দেন। যার ফলশ্রুতিতে হেয়ার সাহেবের উদ্যোগে ১৯০৯ সালে মন্টে-মির্লো সংস্কারে ৩১টি নিম্নবর্গীয় জাতিকে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ দেওয়া হয়। এর সাথে বাংলার আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণীর একজন নির্বাচিত ও একজন মনোনীত সদস্য গৃহীত হোন। সারা ভারতে সেটাই ছিল প্রথম। তখন ভবিষ্যতের দলিত নেতা ভীমরাও রামজি শাঙ্খপল বা বাবাসাহেব আম্বেদকর সবে ১৮ বছরে পদার্পণ করেছেন।
এরপর ১৯১৩তে সরকারী হোস্টেল ও ১৯১৫তে সরকারী দফতরে সংরক্ষণ চালু হয়। সারাভারতে তা চালু হয় ১৯১৯ সালে। ১৯২২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর আমূল ভূমি সংস্কারের দাবি তোলেন। এর কিছু পরেই নমশূদ্র সমাজের রসিকলাল বিশ্বাস সৈয়দ নওশের আলির সাথে মিলে নির্বাচনে জিতে যশোর জেলা বোর্ড এবং যশোর সদর, শিলাইদহ, মাগুরা, নাড়াইল ও বনগা এই মহকুমা বোর্ড দখল করেন। ১৯৩২ সালের পুনা চুক্তিতেও রসিকলাল বিশ্বাসের দৃঢ়তার ফলে বাংলায় অনুন্নত শ্রেণীর আসন সংখ্যা ১০ থেকে বেড়ে ৩০টি করা হয়। এরপর ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ফজলুল হক ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মিলিত সরকার ছিল এক মাইলফলক স্বরূপ। অতএব দেখা গেল, বাংলার দলিত সমাজের এই অগ্রগতি কেবল কোন সম্প্রদায়ের সাফল্য নয়, এতে নমশুদ্রসহ অন্যান্য দলিত সমাজ তো বটেই, মুকুম মিয়া, নওশের আলি, ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম ও ডঃ মীডের মত খৃষ্টানদেরও অবদান অনস্বীকার্য্য।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। Wikimedia Commons
অবিভক্ত বাংলায় দলিত রাজনীতির সাফল্য নিয়ে আলোচনা হল এবার এই সাফল্যে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১৯৩৭এর নির্বাচন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শক্তি হ্রাসের অনুভূতি এনে দেয়। এর পরিণতিতে জাতীয় কংগ্রেস, ভারত সেবাশ্রম হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক আকারে দলিতদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। জাতপাতবিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি ছিল আসলে দলিতদের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ছাতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার আপাত কাজকর্ম কমতে থাকে। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার মধ্যে দিয়ে দলিতদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রক্রিয়া রোধের চেষ্টা করা হয়। আদিবাসীদের মধ্যেও এই কর্মকান্ড চলতে থাকে। এর আগে জিতু সাঁওতালকে দিয়ে আদিনার পরিত্যক্ত মসজিদে কালীমূর্তি বসানোর প্রয়াস চলেছিল। ভারত ছাড়ো, তেভাগা ও অন্যান্য আন্দোলন এই প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। কৃষক প্রজা পার্টির ব্যর্থতা, প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়। ১৯৪৫ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এই প্রক্রিয়ার সুফল আসে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিতে। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের তফসীলি রাজনীতি খুব বেশী আসন পায়না। ১৯৪৬এ কংগ্রেসের হাত ধরেই গণপরিষদে যান হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গণপরিষদে যান। ১৯৪৬-৪৭এর দাঙ্গায় আবাঙালিদের পাশাপাশি লেঠেলবাহিনীতে দলিতদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর দেশভাগের ফলে উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন ও অধিকারের লড়াইতে বামপন্থী দলগুলো হাওয়া পেতে থাকে। ভূমিসংস্কার প্রক্রিয়া প্রান্তিক সমাজে বামফ্রন্টের গ্রহণযোগ্যতা বহুদিন ধরে রাখে। তৃণমূলের উত্থানও ঘটে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের হাত ধরে। কৃষকের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার ইত্যাদি মন্দ্রধ্বনিতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে দলিত সমাজের কারো অনুপস্থিতির প্রশ্ন নিরুচ্চারিতই থেকে যায়।
অন্যদিকে যাঁরা এই প্রশ্নগুলো তুলতে থাকেন তাঁদেরও পদ্ধতিগত বহু ত্রুটি অনস্বীকার্য্য। যখন বাম ও তৃণমূলের প্রশাসনিক ব্যর্থতার মাঝে বিকল্প কোন শক্তির খোঁজ চলছিল সেখানে বাংলার পরিস্থতির সাথে মানানসই কোন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। অসুর সম্প্রদায়ের মানুষের সংহতিতে অসুর উৎসব জনপ্রিয়তা পেলেও ব্রাহ্মণবিদ্বেষ কিম্বা আম্বেদকরপন্থী নবযান বৌদ্ধমত কোন কাজে আসেনি। অন্যদিকে দলিত আন্দোলনের অগ্রদূতরা থেকে গেছেন মূলধারার তো বটেই, দলিত সমাজেরও বিস্মৃতির আড়ালে। রসিকলাল বিশ্বাসকে শেষ পর্যন্ত দন্ডকারণ্যে দারিদ্রে কাটাতে হয়। যাঁর মাছের ভেড়ির জমিতে সল্টলেক নগরী গড়ে উঠেছে সেই হেমচন্দ্র নস্করের নামে বিধাননগরে কোন স্মৃতিচিহ্ন বিশেষ চোখে পড়ে না। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পাশাপাশি যাঁরা আম্বেদকরকে গণপরিষদে নির্বাচিত করেছিলেন সেই নগেন্দ্রনারায়ণ রায়, দ্বারিকানাথ বারুরী, গয়ানাথ বিশ্বাস, ক্ষেত্রনাথ সিংহ, চুনীলাল বিশ্বাস কিম্বা মুকুন্দবিহারী মল্লিকের স্মৃতিরক্ষার কোন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা হয়েনি। তাই মূলস্রোতের রাজনৈতিক মননে তো বটেই, দলিত রাজনীতির পরিসরেও এঁদের কোন জায়গা হয়নি। তাই পথপ্রদর্শকদের ভুলে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে দলিত রাজনীতি। অন্যদিকে দলিত-মুসলিম ঐক্যের কথা বলা হলেও এই সমাজগুলো এমনিতেই বহুধাবিভক্ত। আর একে অন্যকে না বোঝার ফলে কোনও প্রচেষ্টা এখনও পর্যন্ত ফলপ্রসু হয়নি।
আর এখনকার ব্যয়বহুল নির্বাচনী রাজনীতিতে সাফল্য দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই কারণেই বাংলায় দলিত আন্দোলন নির্বাচনী সাফল্য পাচ্ছে না।